হেবা দলিলের শর্ত এবং দলিল নিবন্ধন
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হেবা দলিল (Heba Deed) একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তার সম্পত্তি বিনামূল্যে বা নিঃস্বার্থভাবে আরেকজনের কাছে হস্তান্তর করেন। ইসলামি শরীয়ত অনুসারে এবং বাংলাদেশ আইন অনুযায়ী, হেবা একটি অত্যন্ত বৈধ এবং সুরক্ষিত পদ্ধতি হলেও, এটি কার্যকর হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ করা বাধ্যতামূলক। এই প্রবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে হেবা দলিলের ধারণা, হেবা দলিলের বৈধতার জন্য আবশ্যকীয় শর্তাবলী, এবং প্রাসঙ্গিক বিচারিক ব্যাখ্যা তুলে ধরবো।
হেবা দলিল কী?
হেবা হলো এমন একটি স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি (দাতা বা দানকারী) তার সম্পত্তি বা সম্পদের মালিকানা বিনা মূল্যে (বিনা বিনিময়ে) অপর ব্যক্তিকে (গ্রহীতা বা মুতাহিব) প্রদান করেন এবং সেই ব্যক্তি তা গ্রহণ করে। এটি ইসলামী আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং ফিকাহ শরীফে এর বিশদ আলোচনা আছে। হেবা শব্দটি আরবি “হিবাহ” (هبة) শব্দ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ হলো “উপহার” বা “দান”।
বাংলাদেশের ‘ট্রান্সফার অব প্রপার্টি অ্যাক্ট, ১৮৮২’ (Transfer of Property Act, 1882) এর আলোকে হেবা দলিল একটি বৈধ সম্পত্তি হস্তান্তরের মাধ্যম।
হেবা দলিল সম্পাদনের মূল উপাদান

হেবা দলিল কার্যকর হওয়ার জন্য তিনটি মৌলিক উপাদানের উপস্থিতি প্রয়োজন:
- ✅ প্রস্তাব (Offer) — দাতার পক্ষ থেকে নিঃস্বার্থ সম্পত্তি দানের প্রস্তাব।
- ✅ গ্রহণ (Acceptance) — গ্রহীতার পক্ষ থেকে সেই প্রস্তাব গ্রহণ।
- ✅ হস্তান্তর (Delivery of Possession) — সম্পত্তির দখল বা হস্তান্তর।
এই তিনটি উপাদান ছাড়া হেবা সম্পূর্ণ হয় না। এমনকি দলিল নথিভুক্ত হলেও যদি প্রকৃত দখল হস্তান্তর না হয়, হেবা অসম্পূর্ণ বিবেচিত হতে পারে।
হেবা দলিলের বৈধতার জন্য আবশ্যকীয় শর্ত
একটি হেবা দলিলকে বৈধ ও কার্যকর করতে হলে নিম্নলিখিত শর্তসমূহ পূরণ করতে হবে:
১. দাতার যোগ্যতা
- দাতাকে অবশ্যই বালিগ (প্রাপ্তবয়স্ক), স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন এবং নিজের সম্পত্তির মালিক হতে হবে।
- দাতা যদি অপ্রাপ্তবয়স্ক বা মানসিকভাবে অক্ষম হন, তবে তার হেবা বৈধ হবে না।
- দাতা যদি চাপ, প্রতারণা বা প্রলোভনের মধ্যে পড়ে হেবা প্রদান করে, তাহলে সেই হেবা বাতিলযোগ্য হবে।
২. গ্রহীতার যোগ্যতা
- গ্রহীতা হতে পারে কোনও ব্যক্তি বা কোম্পানি/প্রতিষ্ঠান।
- বালক বা অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির ক্ষেত্রেও হেবা বৈধ, তবে তার পক্ষ থেকে অভিভাবক গ্রহণ করতে পারে।
- দাতার স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয় কিংবা সম্পূর্ণ বাইরের কেউও গ্রহীতা হতে পারে।
৩. সম্পত্তির বৈধতা
- হেবা কেবলমাত্র দাতার বৈধ মালিকানাধীন সম্পত্তি হতে পারে।
- অর্পিত সম্পত্তি, সরকারি নিষিদ্ধ সম্পত্তি, বা চুক্তিভিত্তিক দায়বদ্ধ সম্পত্তি হেবা করা যাবে না।
- সম্পত্তি অবশ্যই আইনসম্মতভাবে হস্তান্তরযোগ্য হতে হবে।
৪. বিনিময়হীনতা
- হেবা নিঃস্বার্থভাবে প্রদান করতে হয়; এর জন্য কোনও অর্থমূল্য বা বিনিময় থাকা যাবে না।
- যদি বিনিময় থাকে তবে এটি হেবা-বিলা-ঈওয়াজ (Heba-bil-ewaz) হিসেবে বিবেচিত হবে এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন নিয়ম প্রযোজ্য হবে।
৫. স্পষ্ট ঘোষণা এবং গ্রহণ
- দাতাকে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করতে হবে যে, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে সম্পত্তি দান করছেন।
- গ্রহীতাকে সেই ঘোষণা গ্রহণ করতে হবে — মৌখিক বা লিখিত যেকোনোভাবে।
- কেবল দলিলে স্বাক্ষর করলেই হবে না; বাস্তবে গ্রহীতার সম্পত্তির উপর দখল প্রতিষ্ঠা আবশ্যক।
৬. দখল হস্তান্তর
- হেবা সম্পূর্ণ হতে হলে দাতাকে প্রকৃতপক্ষে সম্পত্তির দখল হস্তান্তর করতে হবে।
- দখল না দিলে দলিল বৈধ হলেও হেবা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে এবং ভবিষ্যতে তা চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
- বসবাসযোগ্য সম্পত্তি হলে গ্রহীতাকে সেখানে বসবাস করতে দেওয়া, অথবা জমি হলে তার চাষাবাদ বা ব্যবহারের অধিকার প্রদান করা আবশ্যক।
দলিল নিবন্ধন সংক্রান্ত শর্ত
রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট, ১৯০৮ অনুযায়ী:
- স্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে (যেমন ভূমি বা ভবন) হেবা দলিল নিবন্ধন বাধ্যতামূলক।
- নিবন্ধন ছাড়া স্থাবর সম্পত্তির হেবা আইনি বৈধতা পাবে না এবং আদালতে প্রয়োগযোগ্য হবে না।
- হেবা দলিল নিবন্ধন করতে হবে স্থানীয় সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে।
- দলিল নিবন্ধনের জন্য দাতার উপস্থিতি প্রয়োজন এবং প্রয়োজনীয় স্ট্যাম্প ডিউটি প্রদান করতে হবে।
হেবা দলিল সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিচারিক ব্যাখ্যা
বাংলাদেশের বিচার বিভাগ হেবা দলিলের বৈধতা নির্ধারণে বেশ কিছু রায় প্রদান করেছে। উদাহরণস্বরূপ:
- যদি কোনও পক্ষ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয় যে প্রকৃতপক্ষে দখল হস্তান্তর হয়েছে, তবে হেবা বাতিলযোগ্য হয়ে যায়।
- কেবলমাত্র পারিবারিক সম্পর্কের ভিত্তিতে হেবা ধরে নেওয়া যায় না; বরং দলিল এবং দখলের প্রমাণ আবশ্যক।
- হেবা সম্পন্ন হওয়ার পর দাতা সেই সম্পত্তিতে আর কোনও অধিকার রাখেন না।
হেবা দলিল বাতিল করার প্রক্রিয়া
একবার সঠিকভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর হেবা সাধারণত বাতিলযোগ্য নয়। তবে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে হেবা বাতিল করা যেতে পারে:
- দাতা যদি প্রমাণ করতে পারে যে গ্রহীতা প্রতারণা করেছে বা চাপ প্রয়োগ করেছে।
- যদি কোনও পূর্বনির্ধারিত শর্ত লঙ্ঘন হয়।
- বাবা-মা তাদের সন্তানের হেবা ফিরিয়ে নিতে পারেন যদি তা তাদের জীবিকা বিপন্ন করে।
তবে, সাধারণত ক্যাভিয়াট ইম্পারেটর নীতির (Caveat Emptor – ‘ক্রেতা সাবধান’) মত, হেবা প্রদানকারীকে দানের পরে ফেরত চাওয়ার অধিকার থাকে না।
হেবা দলিল তৈরি করার সময় করণীয়
- একটি আইনজীবীর মাধ্যমে সঠিক খসড়া তৈরি করা।
- দাতা ও গ্রহীতার জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি সংগ্রহ।
- সম্পত্তির দলিলপত্র, খাজনা পরিশোধের কাগজপত্র সংযুক্ত করা।
- সাক্ষীদের উপস্থিতিতে দলিল সম্পাদন করা।
- দলিল রেজিস্ট্রেশন করে দখল হস্তান্তরের সাক্ষ্য রাখতে দলিলের অনুলিপি সংগ্রহ করা।
হেবা দলিলের সুবিধা
- ✅ পারিবারিক সম্পত্তি স্থানান্তর সহজ হয়।
- ✅ উইলের প্রয়োজনীয়তা কমে যায়।
- ✅ উত্তরাধিকারের দ্বন্দ্ব কমানো যায়।
- ✅ কর কমানোর সুবিধা পাওয়া যায় নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে।
হেবা দলিলের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু গুরুত্বপূর্ণ শব্দ
শব্দ | অর্থ |
---|---|
দাতা | যিনি দান করেন |
গ্রহীতা | যিনি দান গ্রহণ করেন |
কাবুল | গ্রহণ |
কবজা | দখল |
হেবা-বিলা-ঈওয়াজ | বিনিময়সহ হেবা |
উপসংহার
হেবা দলিল বাংলাদেশের রেওয়াজ ও আইন উভয় ক্ষেত্রেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে হেবা সম্পন্ন করতে গিয়ে অবহেলা বা ভুল করলেই ভবিষ্যতে তা আইনগত সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। এজন্য দলিল তৈরির সময় সাবধানতা, সঠিক নিয়ম অনুসরণ এবং একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শ গ্রহণ অপরিহার্য।
হেবাকে কেবল একটি দান নয়, বরং একটি গুরুতর আইনগত ব্যবস্থা হিসেবে দেখা উচিত। যথাযথ শর্ত পূরণ করে করা হেবা দলিল ব্যক্তিগত সম্পত্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে এক অনন্য ও সুরক্ষিত মাধ্যম।