মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন ২০২৪
বাংলাদেশে ৩ ধরনের বিবাহ হয়ে থাকে-
এক হচ্ছে মুসলিম বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ (নিবন্ধন) আইন অনুযায়ী কাজি অফিসে নিবন্ধন হয়।
২য়টি হচ্ছে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন অনুযায়ী যেটাকে Traditional marriage এর category তে পড়ে এটা হিন্দু বিবাহ রেজিস্ট্রার কাছে নিবন্ধন করতে হয়।
৩য় হচ্ছে special marriage Act 1972 সনের আইন অনুযায়ী হয়। এই বিশেষ বিবাহের জন্য ছেলে-মেয়ে উভয়কে একটা হলফনামা দিতে হবে যে, স্বামী স্ত্রী উভয় যার যার ধর্ম পালন করবে। এই হলফনামাটি আইনজীবী দিয়ে নোটারি পাবলিকের মাধমে সত্যায়িত করে আপনারা স্পেশাল ম্যারিজ রেজিস্ট্রারের নিকট বিবাহ রেজিষ্ট্রেশন করতে পারবেন।
মনে রাখবেন মেয়েদের জন্য বিবাহের বয়স হচ্ছে ১৮ এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে ২১ হতে হবে।
এই ৩ বিবাহ করতেই পাএ/পাএীর পাসপোর্ট সাইজের ছবি, ২ জন স্বাক্ষী সহ আপনাদের পাএ/পাএীর জন্মনিবন্ধন বা জাতীয় পরিচয়পএ লাগবে।
মুসলিম আইনে তালাকের প্রকারভেদ-
মুসলিম শরিয়াহ ও মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ মোতাবেক তালাক দুই প্রকার । আবার, মুসলিম মুল আইন অনুযায়ী, তালাকের বিভিন্ন প্রকার রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রযোজ্য আইনের আলোকে ২ (দুই) প্রকারের তালাকের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে থাকে । যথা-
১) নোটিশ দ্বারা তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদ ।
২) পারস্পারিক / সম্মতিক্রমে বিবাহবিচ্ছেদ।
নিচে দুই ধরনের তালাকের ধারনা দেওয়া হলঃ
নোটিশ দ্বারা তালাক-
নোটিশ দ্বারা বিবাহবিচ্ছেদ একতরফা বিবাহবিচ্ছেদ হিসাবেও পরিচিত। নোটিশের মাধ্যমে ডিভোর্স বা তালাক দিতে, ডিভোর্স নোটিশ প্রাপকের সম্মতি বাধ্যতামূলক নয় । এই ক্ষেত্রে, উভয় পক্ষের মধ্যে তালাক দেওয়ার সম্মতি নাও থাকতে পারে।
পারস্পরিক / সম্মতিক্রমে বিবাহবিচ্ছেদ-
পারস্পরিক / সম্মতিত্রমে বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে, উভয় পক্ষেরই তালাক দিতে তাদের সম্মতি রয়েছে। যেহেতু উভয় পক্ষ বিবাহবিচ্ছেদের বিষয়ে সচেতন তাই নোটিশের প্রয়োজনীয়তা বাধ্যতামূলক নয়।
বিবাহবিচ্ছেদের পদ্ধতিঃ
মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ এর ধারা ৭ অনুযায়ী, যখন একজন ব্যক্তি একতরফা তালাক দেয়, তখন সে নিম্নরূপ পদ্ধতি অনুসরণ করেঃ
১) নোটিশ পদ্ধতি ছারা একতরফা তালাক-
- স্বামী বাস্ত্রী যেই তালাক দিক না কেন তাকে অন্য পক্ষকে এবং সংশ্লিষ্ট সিটি কর্পোরেশন বা চেয়ারম্যানকে তালাকের নোটিশ দিতে হবে।
- তালাক প্রদানকারী ব্যক্তিকে বিবাহ নিবন্ধকের নোটিশ এবং বইতে তার বুড়ো আঙুলের ছাপ দিতে হবে এবং স্বাক্ষর করতে হবে।
- বিবাহ নিবন্ধকের বইয়ের নোটিশে ২ (দুই) জন পুরুষ সাক্ষী স্বাক্ষর করবেন।
- নোটিশ নিবন্ধিত পোস্ট মাধ্যমে পাঠানো হবে ।
- নোটিশ পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট সিটি কর্পোরেশনের কার্যালয় পরপর ৩ (তিন) মাসে স্থামী-স্ত্রীকে ৩ (তিন)টি নোটিশ জারি করবে।
- সিটি কর্পোরেশন স্বামী-স্ত্রীর বিরোধ নিরসনের জন্য একটি সালিশি পরিষদ গঠন করবে ।
- কোন পক্ষ উপস্থিত না হলে বা সমাধান করা সম্ভব না হলে সিটি কর্পোরেশন একটি আদেশ পত্র জারি করবে ।
- বিবাহ নিবন্ধক একটি বিবাহবিচ্ছেদ সনদপত্র জারি করবেন ।
২) পারস্পরিক / সম্মতিক্রমে বিবাহবিচ্ছেদ-
মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ এর ধারা ৮ অনুযায়ী, যখন একজন ব্যক্তি পারস্পরিক বিবাহবিচ্ছেদ দেয়, তখন সে নিম্নরূপ মেনে চলে-
- সাধারনত, স্বামী এবং স্ত্রী উভয়েই বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়।
- বিবাহ নিবন্ধকের খাতায় স্বামী-স্ত্রী এবং ২ (দুই) জন সাক্ষী স্বাক্ষর করেন।
- সাধারণত, বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্তে আসার আগে, উভয় পক্ষ তাদের নির্ধারিত শর্তাবলীতে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
- পক্ষগুলি বেশিরভাগই যৌতুকের টাকা, স্ত্রী ও সন্তানের ভরণপোষণ (যদি থাকে) সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়।
- যেহেতু দুইপক্ষ একে অপরের সিদ্ধান্ত জানে এবং সেখানে যদি সমাধানের কম সম্ভাবনা থাকে তাহলে নোটিশের প্রয়োজন নেই।
গর্ভাবস্থায় বিবাহ বিচ্ছেদের পদ্ধতিঃ
তালাক ঘোষণার সময় স্ত্রী গর্ভবতী হলে, নোটিশের তারিখ থেকে ৯০ দিন বা গর্ভাবস্থা, যেটি পরে হবে, তার নির্ধারিত সময় শেষ না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না।
বিবাহবিচ্ছেদ প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রঃ
বিবাহবিচ্ছেদ প্রত্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য নিসুলিখিত কাগজপত্র প্রয়োজনীয়:
১. কাবিননামার ফটোকপি ।
২. স্বামী এবং স্ত্রীর জাতীয় পরিচয় নম্বরপত্রের অনুলিপি।
৩. দুইজন পুরুষ সাক্ষীর জাতীয় পরিচয় নম্বরপত্রের ফটোকপি ।
৪. ০১ (এক) কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি যদি কোনো আইনজীবী দ্বারা কোনো হলফনামা প্রস্তুত করা হয়।
বিবাহবিচ্ছেদ প্রক্রিয়া সম্পন্রের জন্য সরকারী খরচ:
বিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদ (রেজি) বিধি, ১৯৭৫ অনুযায়ী-
একজন নিকাহ বা বিবাহ নিবন্ধক বিবাহবিচ্ছেদের নিবন্ধনের জন্য ২০০ টাকা (দুইশত) ফি চার্জ করবেন । বিবাহ নিবন্ধক ২৫ টাকা কমিশন ফি
ছিসেবে এবং ০১ (এক) টাকা প্রতি কিলোমিটার হিসেবে ভ্রমণ খরচ হিসাবে দাবি করতে পারেন । কিন্তু বর্তমানে একজন বিবাহ নিবন্ধক প্রকৃত খরচের চেয়ে বহুগুণ বেশি খরচ দাবি করে থাকেন।
মুসলিম স্ত্রী তালাক দিলে স্বামীর থেকে মোহরের টাকা পাবে কিনা?
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী একজন স্ত্রী তালাক দেওয়ার অধিকার প্রয়োগ করতে পারে। তবে কাবিননামার ১৮ নং কলামে স্বামী কর্তৃক যদি সেই ক্ষমতা অর্পণ করে থাকে তাহলে। যদি ১৮ নং কলামে স্বামী তালাকের ক্ষমতা অর্পণ না করে, তাহলে স্ত্রী পারিবারিক আদালতে মামলার মাধ্যমে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে। এক্ষেত্রে মেয়ে পক্ষের করণীয় অবশ্যই বিবাহ রেজিস্ট্রেশন এর সময় ১৮ নং কলাম ভালোভাবে দেখে নিশ্চিত করা।
স্ত্রী তালাক দিলেও স্বামী মোহরের সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করতে বাধ্য।
হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ:
বাংলাদেশ হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদের বা তালাকের কোনো নিয়ম নেই। কিন্তু একমাত্র হিন্দু জুডিশিয়াল সেপারেশন এর মাধ্যমেই স্ত্রী তার স্বামীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারবেন। তবে নির্দিষ্ট কারণ দর্শাতে হবে।যেমন :
১। স্বামী খারাপ হলে বা নির্যাতন করলে।
২। স্বামী পূণরায় বিবাহ করলে।
৩। স্বামী যদি বিবাহিত উপপত্নী রাখে।
৫। স্বামী দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত থাকলে।
বা অন্য যে কোনো যৌক্তিক কারণ থাকলে।
স্ত্রী আদালতে গিয়ে সেপারেশন এর আবেদনের মাধ্যমে আলাদা থাকতে পারবে, যদি বিজ্ঞ আদালত চাই বা উপযুক্ত মনে করেন।
খ্রিস্টান মহিলা বা পুরুষ পারিবারিক আদালত আইনের অধীনে বিবাহ বিচ্ছেদ
পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩ ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য ।এখন প্রশ্ন হচ্ছে একজন খ্রিস্টান মহিলা বা পুরুষ পারিবারিক আদালত আইনের অধীনে বিবাহ বিচ্ছেদ চাইতে পারবে কিনা? কারণ আমরা জানি খ্রিস্টানদের বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আলাদা বিবাহ বিচ্ছেদ আইন 1869 (Divorce Act, 1869 )আছে। এই আইনের 4 এবং 10 ধারার বিধান অনুযায়ী তারা জেলা জজ বা ক্ষেত্রবিশেষে হাইকোর্ট ডিভিশনে বিবাহ বিচ্ছেদ চাইতে পারত।
তবে পারিবারিক আদালত আইন 2023 আসার পরে এই আইনের কার্যকারিতা অনেকটা Infructuous হয়ে গেছে। এখন আর তাদেরকে জেলা জজের কাছে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য পিটিশন দায়ের করতে হবে না। তাদেরকে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য পিটিশন দায়ের করতে হবে পারিবারিক আদালতে কারণ বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে পারিবারিক আদালতের (exclusive jurisdiction)আছে।হিন্দু জুডিশিয়াল সেপারেশন কোনো আইন নয়, এটা একটা প্রিন্সিপাল ( ইন্ডিয়াতে এটি অনুসরণ করা হয়)